পঞ্চাশের দশকের সূচনায় কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতারমন্ত্রী হয়ে এলেন বি. ভি. কেশকর। কেশকার মশায়ের মাথা থেকে বেরিয়েছিল যে, ‘ফিল্মি গানা’র আগ্রাসন আটকাতে আকাশবাণীর নিজস্ব খরচে নানান ভারতীয় ভাষায় আধুনিক গানও তৈরি করা দরকার। এই লক্ষ্য নিয়ে তিনি প্রায় প্রতিটি আকাশবাণী কেন্দ্রে সরকারী খরচে আধুনিক গান তৈরির বিভাগ খোলেন। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে তার নাম দেওয়া হল ‘রম্যগীতি’
কলকাতার রম্যগীতি বিভাগে প্রথম প্রযোজকের দায়িত্ব নিলেন সঙ্গীতাচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। ক্রমশ পঞ্চাশের দশকে আকাশবাণী কলকাতার রম্যগীতি বিভাগটি হয়ে উঠতে লাগল অসামান্য সুরসমৃদ্ধ। বেশ কিছু আধুনিক বাংলা গানের জন্মভূমি। আকাশবাণীতে কত যে বরণীয় গীতিকার, সুরকারের সৃষ্টি। অসাধারণ সব শিল্পীর কন্ঠে মানুষের মন ভরিয়েছে, তার শেষ নেই।
রম্যগীতি সৃজনে আশ্চর্য মমতা ছিল ধ্রুপদী কণ্ঠসঙ্গীতের এক নিজস্ব ঘরানার প্রবর্তক, সঙ্গীতাচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের। তিনি বলতেন, আকর্ষণীয় বাংলা গানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের রাগসঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত করাই তাঁর উদ্দেশ্য। রম্যগীতির সঙ্গে কিন্তু রাগপ্রধান গানের তফাৎ আছে। রাগপ্রধান গানে রাগের ভূমিকাই প্রধান, তার প্রকাশের জন্য বাণীর ব্যবহার। আর রম্যগীতিতে গানের ভিতর দিয়ে রাগের প্রবেশ
জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ নিজে অপূর্ব কিছু রম্যগীতি গেয়েছিলেন। তাঁর গুণী ছাত্র প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি অসাধারণ গান- ‘নিশীথ শয়নে জাগে আঁখি উদাসী’ কথা ও সুরের মায়াজালে সঙ্গীতাচার্যের সৃষ্টি আরও দুটি অসামান্য গান- ‘কূল ছেড়ে এসে মাঝদরিয়ায় পিছনের পানে চাই’ গেয়েছিলেন বাণী কোনার আর ‘আমি সুরে সুরে ওগো তোমায় ছুঁয়ে যাই’- এর সুরে মুগ্ধ করেছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সুরসৃজনে গোপাল দাশগুপ্তের রচনা ‘বন্ধু হে পরবাসী’ প্রাণ পেয়েছিল মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গায়কীতে। পরবর্তীকালে অজয় চক্রবর্তীর কণ্ঠেও অসাধারণ কিছু গান শোনা গেছে। তাঁর অন্যান্য ছাত্রছাত্রীরাও অনেকে গাইতেন। সঙ্গীতাচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ছিলেন এক বিরলতম প্রতিভা। একে তো ভার্সেটাইল জিনিয়াস, তার ওপর উচ্চশিক্ষিত ৷ মিউজিশিয়ানদের ক্ষেত্রে সে যুগে এরকম কম্বিনেশন পাওয়া দুর্লভ৷ মূলত তবলা আর কন্ঠসঙ্গীতের গুরু হয়েও সঙ্গীতাচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ আর একটি অনবদ্য কাজ করেছিলেন
‘গন্ধবিচার’ (সিংহাসনে বসল রাজা বাজল কাঁসর ঘন্টা), ‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম’ (ছুটছে মোটর ঘটর ঘটর), আর ‘নেড়া বেলতলায় যায় ক’বার’ (রোদে রাঙা ইঁটের পাঁজা) – সুকুমার রায়ের এই তিনটি অমর সৃষ্টিতে সুর সংযোজনা করেছিলেন। নিজে কন্ঠও দিয়েছিলেন। তিনটি গানই পাঁচের দশকে রম্যগীতির আসরে শোনানো হয়েছিল। ওই ধরণের গানের প্রযোজনার আঙ্গিক যে কেমন হতে পারে, তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন সঙ্গীতাচার্য জ্ঞানপ্রকাশ। কিন্তু পরবর্তীকালে এই গানগুলি সকলের সামনে আর আসেনি। এমন অতুলনীয় তিনটি গানের সুর-তাল-ছন্দ ও গায়কী নিয়ে আর কোন চর্চাও হয়নি
আকাশবাণীর এই বিভাগেই গোপাল দাশগুপ্ত, সুরেন পাল, আলী আকবর খান, তিমির বরণ, অনিল বাগচি, ভি বালসারা, অলোকনাথ দে, নিখিল ঘোষ, দুনিচাঁদ বড়াল, সলিল চৌধুরী, প্রবীর মজুমদারের মত সুরকাররা এমন কিছু সুর সৃষ্টি করেন যা যে কোন সভ্য জাতির জন্য গর্বের বিষয় হওয়ার কথা। আকাশবাণীর রম্যগীতির ঐতিহ্য ও ইতিহাস ৬০ বছরের। পরবর্তীকালে বিনোদনের কত না উপকরণ! ফলে মানুষের মন থেকে ক্রমশ রম্যগীতির সেই আবেশ যেন হারিয়ে যেতে লাগল
একসময় বন্ধ হয়ে গেল রম্যগীতি। রেডিওর সোনালি দিনের সেইসব রম্যগীতি শ্রোতারা যেসব কণ্ঠে শুনেছিলেন সেদিন, তাঁদের স্মৃতিতে সেই কণ্ঠগুলি আজও অমলিন। সেই কন্ঠগুলির বয়স বোধহয় বাড়েনি আজও। কিন্তু রম্যগীতির গুরুত্ব ও ঐতিহ্য সম্পর্কে আজকের শ্রোতারা হয়তো তেমন কিছুই জানেন না। এমন সমৃদ্ধ ও অতুলনীয় এক সঙ্গীতধারা এখনকার প্রজন্মের কাছে অধরাই থেকে গেল
সুত্রঃ কবীর সুমন ও কেয়া মুখোপাধ্যায়ের লেখা থেকে সঙ্কলিত