একবার গ্রামোফোন কম্পানির বড় বাবু "হেমচন্দ্র সোম" জগন্ময় মিত্রকে নিয়ে গেলেন কাজী নজরুল ইসলামের কাছে। প্রথম পরিচয়ে জগন্ময় মিত্রকে আপন করে নিলেন নজরুল। তখন জগন্ময় মিত্র বললেন, তিনি একটা গান লিখে সুর করেছেন; যদি কাজী সাহেব একটু শুনতেন?
নজরুল বললেন- "শুনাও"। গান শোনার পরে নজরুল উৎসাহ দিয়ে বললেন, জগন্ময় ভালোই লিখেছেন কিন্তু লেখার চেয়ে সুর আরো ভালো হয়েছে। জগন্ময় মিত্র প্রস্তাব দিলেন- যদি নজরুল তার সুরের উপরে গানটা লিখে দেন।
সেদিন, ওইখানে বসে বসেই গান লিখলেন কাজী নজরুল ইসলাম এবং জগন্ময় মিত্র ওইখানে বসেই তার নিজের সুরে কাজী নজরুলের কথায় গানটা গাইলেন। শুনে প্রশংসা করলেন নজরুল। গানটি তখন ১৯৩৯ সালে রেকর্ড হয়েছিলো গ্রামোফোন কম্পানিতে গেয়েছিলেন জগন্ময় মিত্র।
এর অনেক বছর পরে ১৯৭৯ সালে দেবদাস সিনেমাতে গানটি ব্যাবহার করা হয়। তখন প্লেব্যাক করেন মান্না দে। এই সিনেমাতে সেই গানের লিপ মিলিয়ে ছিলো মহানায়ক উত্তম কুমার। এই পোষ্টে আমি সেই কালজয়ী গানটির লিরিক্স শেয়ার করবো আপনার জন্যে-
শাওন রাতে যদি (Shaono Rate Jodi)
🎧 Song Credits:
Shaono Rate Jodi Song Lyrics 👇
শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে
শাওন রাতে যদি।
শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে
শাওন রাতে যদি।
ভুলিও স্মৃতি মম, নিশীথ স্বপন সম
ভুলিও স্মৃতি মম, নিশীথ স্বপন সম
আঁচলের গাঁথা মালা, ফেলিও পথ পরে
বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে
শাওন রাতে যোদি।
ঝুরিবে পূবালি বায় গহন দূর বনে
ঝুরিবে পূবালি বায় গহন দূর বনে
রহিবে চাহি তুমি একেলা বাতায়নে।
বিরহী কুহু কেকা গাহিবে নীপ শাখে
যমুনা নদী পারে, শুনিবে কে যেন ডাকে।
বিজলী দীপশিখা খুঁজিবে তোমায় প্রিয়া
দু হাতে ঢেকো আঁখি যদি গো জলে ভরে।
বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে
শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে
শাওন রাতে যদি…
🔊 কিছু কথা: সেই সময়ে রেকর্ড করার জন্যে যাঁরা গান লিখতেন অথবা সুর করতেন তাঁদের নাম রেকর্ড লেবেলে ছাপা হতো না। প্রায় তিরিশের দশক থেকে ধীরে ধীরে এই নিয়মের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। কন্ঠ-শিল্পীর পাশাপাশি তখন গীতিকার ও সুরকারের নাম রেকর্ডে উল্লেখ হতে থাকে এবং সেই থেকে জানা সম্ভব হয় মুলত গীতিকার বা সুরকারের নাম।
মুলত
নজরুলের পর আধুনিক বাংলা গানের পর্ব শুরু হতে থাকে। কথা, সুর ও গায়কিতে দেখা গেলো নজর করার মতো পরিবর্তন। তবে অবশ্যই নজরুলের প্রভাব, গীতিকারদের কারো কারো ওপর কমবেশি যে পড়েছিল তা স্বিকার করার কোন উপায় নেই।
ও হ্যা গ্রামোফোন কোম্পানি লিমিটেডের দুই শাখা –
এইচএমভি ও টুইনের কর্তা ছিলেন দুই হেম – হেমচন্দ্র গুহ ও হেমচন্দ্র সোম। হেমচন্দ্র গুহের পর এইচএমভির দায়িত্বে আসেন হেমচন্দ্র সোম। একদম প্রথমেই যার কথা বলেছিলাম।
🔊 আমার মতামত - অনেকের ধারনা যদিও,
"শাওন রাতে যদি" এই গানটির সুরকার স্বর্গত
সিদ্ধেস্বর মুখোপাধ্যায়।
জগন্ময় মিত্র যখন গানটি রেকর্ড করেন তখন তিনি খ্যাতির মধ্য গগনে। সিদ্ধেস্বর বাবুর সম্মতিক্রমে তিনি গানটিতে কিছু সংযোজন বা সংবর্জন করেছিলেন মাত্র। তবে আমার জানা তথ্য অনুযায়ী জগন্ময় মিত্রের কন্ঠে এই একই সুরে অন্য একটি গান শুনে
কাজী নজরুল ইসলামের সুরটা বেশ পছন্দ হয়। কিন্তু গানের কথা দুর্বল ছিলো বিধায় গানের বাণীটি নূতন করে লিখে দেন নজরুল এবং গানটি জগন্ময় মিত্রের কন্ঠে রেকর্ড করা হয় তখন।
গানটির সুরকার এবং প্রথম গায়ক
জগন্ময় মিত্র। এই গানটি
সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ও গেয়েছেন যেমন,
"আমি চিরতরে দূরে চলে যাব" তবে এটা ঠিক যে
মান্না দে আরো উঁচু পর্যায়ের গায়ক। মান্না দের গাওয়া ভার্সনটি অরিজিনাল গানটির সবথেকে কাছাকাছি। বাকিরা অনেক বেশি স্বাধীনতা নিয়েছেন যা অনেক ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতার পর্যায়ে চলে গেছে।
নজরুলের লেখা আরো কিছু গান যদি
মান্না দে গেয়ে যেতেন তবে বাংলা গানের জন্য সেটা বিরাট পাওয়া হতো। পদ্মভূষণ
মান্না দে কবি নজরুলের ১৬ খানি
নজরুল সংগীত গেয়েছেন। এই গানটা অসম্ভব ভালো গেয়েছেন মান্না দে, আর কেউ এই গানটা এত ভালো গাইতে পারবে না কোনোদিন এটা আমার বিশ্বাস।
নজরুলের প্রতিটি সৃষ্টিই অসাধারণ। স্রষ্টার অনবদ্য সৃষ্টি তাতে সাবলীল কণ্ঠ দিয়েছেন শিল্পী
মান্না দে। চিরদিনের জন্য অমরত্ব লাভ করেছে এই গানটি। আগামী প্রজন্মের কাছেও সম ভাবে সমাদৃত থাকবে।
আর তাই এখানে লিখে গেলাম আমি। অনেকদিন পরে যখন আপনি বা আমি থাকবোনা তখন আমাদের পরিচিত কেউ হয়তো দেখবে আমাদেরও পছন্দ ছিলো গানটি ঠিক তাদের মত। তাদের সময়ে যেভাবে তারা সিগারেটের ধোঁয়া-মাখা সন্ধ্যায় গানটি শুনবে আমরাও শুনতাম আমাদের সময়ে। মানুষ বদলাবে, ঋতু বদলাবে গানটার তখনো থাকবে চির বসন্ত! ❤️